আহমদ সফি উদ্দিন: আনিস ভাই এত তাড়াতাড়ি কেটে পড়লেন কেন? আপনি তো চির যুবক হতে চেয়েছিলেন। কেউ বয়সের কথা বললে রাগ করতেন। পাল্লা দিয়ে তরুন সাজতেন। তরুণ সাংবাদিকদের হার মানাতেন কি লেখায়, কি শ্রমে, কি ছোটাছুটিতে। মোটা চশমার ফ্রেম দিয়ে আপনি কিভাবে এত পড়াশোনা করতেন তাও অজানাই থেকে গেল। যেখানে স্বাভাবিক ভাবে রাস্তায় চলতে গিয়ে আপনার অসুবিধা হচ্ছে মনে হতো সেখানে এত কাজ করতেন কেমন করে?
আপনার হাতের লেখাতো রীতিমতো ঈর্ষণীয়। মেপে মেপে ওজন করে শব্দ রচনা আর তা থেকে আলো বের হবার মত রিপোর্ট ক’জন করতে পারে? ক’জন পারে এক নিমেষের মধ্যে এই শহরের এই উত্তরের হাজার বছরের ইতিহাস হাজির করতে। ভালবেসে ছিলেন আপনি গ্রাম বাংলার মানুষ আর মাটিকে।
আপনি আসলেই কি একজন সাকসেসফুল রিপোর্টার? ফটোগ্রাফার? কলামিষ্ট? ফিচার রাইটার? এডিটর? নাকি পিআরও? নাকি সাহিত্যিক? ঐতিহাসিক? নাকি শিক্ষক? নাকি আসলে আপনি গবেষক? এই প্রশ্নের উত্তর আমি আজও খুঁজে পাইনি।
জানা হয়নি আপনি বাংলার ছাত্র হয়েও ইতিহাসের গৌরব খুঁজে বেড়াতেন কেন? ভাঙ্গা মসজিদ আর মন্দির কেন এত প্রিয় ছিল? নিজের জন্মভূমি, শহর আর গ্রামের ইতিহাসটা না জানা থাকলে তো দেশপ্রেম জাগতে পারে না। এই বোধ আর শেকড়ের অনুসন্ধান অনুপ্রেরণা বোধহয় আমি আপনার কাছ থেকেই পেয়েছি।
৩০ বছর আগে দৈনিক বাংলায় জয়পুরহাট থেকে আপনার লেখা গ্রামীণ জীবনের অসাধারণ সব ফিচার ও ছবি গুলো আমার মনে পড়ে। দৈনিক বাংলায় কক্সবাজারের তোফায়েল আহমদ, নোয়াখালীর কামাল উদ্দিন আহমেদ, পাবনার মির্জা শামসুল ইসলাম আর আপনার শ্রেষ্ঠ ফিচারগুলি পত্রিকার সন্মান বাড়িয়েছিল।
সেই সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার হিসেবে একবার বিপদে পড়লাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের চাপে। বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির সভাপতি হিসেবে আপনে সেদিন চিঠি লিখে ধমক দিয়েছিলেন ভিসিকে। আর কপি পাঠিয়েছেন আমাকেও৷ আপনার সাহস আমাদের কলমকে সাহসী করে তুলেছিল। আপনার চিঠি আজও যত্নে রাখা আছে।
আমার দুঃখ হয়, কষ্ট হয়, আপনার সকল প্রতিভা কাজে লাগানোর মতো কেউ এই নগরীরতে জন্মগ্রহণ করলেন না। কেন? প্রায় সারাটি জীবন আপনাকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে অনেকটা ফরমায়েসি লেখালেখি নিয়ে। কাগজের সম্পাদকীয় নীতি আপনাকে বেঁধে রেখেছে। জনসংযোগের বাঁধন আপনাকে আগলে রেখেছে। তবু জীবন আর জীবিকার জন্য সীমিত স্বাধীনতর মধ্যে থেকেও আপনি যা রেখে গেলেন তা সারা জাতির জন্য রাজশাহী জন্য ইতিহাস হয়ে থাকল।
তবে একটা কথা ঠিক আপনি আসলে একজন সাকসেসফুল পিআরও আর সাংবাদিক। তা নইলে আপনার জানাজায় এতো লোক এলো কোথা থেকে। একবার ইত্তেফাকের হাসান শাহরিয়ার ভাই রাজশাহী এসে বলেছিলেন, সাংবাদিকরা সকলেরই অপ্রিয় হয়ে যান। কারণ, তাদের লেখা অনেকের বিপক্ষে যায় আর সেজন্য আমি যাদের বিরুদ্ধে লিখি পরদিন তাদের ফোন করে কুশল বিনিময় করি। আমার অবস্থান ব্যাখ্যা করি।
আপনি যে ঠিক এভাবে ফোন করতেন না আমি জানি। তবে তার চেয়েও অনেক বেশী পাবলিক রিলেশনস ছিল সকলের সাথে আপনার। তাই অবাক লাগতো যাদের সাথে দিন রাত ওঠা বসা করেছেন তাদের কাজের সমালোচনা করেছেন কিভাবে? আসলে সাংবাদিকতার নীতিমালা বজায় রেখে নিরপেক্ষতা রাখতে পেরেছিলেন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে।
আমি অনেকবার আপনাকে বলেছি এবার অন্যের কথা নয় নিজের কথা লিখুন। আপনার শৈশব কৈশোর আর যৌবনের কথা। সাংবাদিকতার বিচিত্র অভিজ্ঞতা কথা যা আগামী জেনারেশনের কাজে লাগবে। না তা আর হলো না। আপনি চুপিচুপি সরে পড়লেন হঠাৎ করে।
আমাদের ব্যর্থতা এমন লেখার হাত আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেল। আমাকে ক্ষমা করবেন।
সাপ্তাহিক দুনিয়ায় প্রকাশিত লেখাটি গতবছর পোস্ট করেন তাঁর কন্যা Ety Rhaman।
লেখকের ফেসবুক ওয়াল থেকে সংগৃহীত।