ডিবিসি নিউজ ডেস্ক: পরিকল্পনা ছিল ২০২০ সালে বিশ্বে বাংলাদেশকে নতুনভাবে তুলে ধরার। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই হবে কোনো না কোনো আয়োজন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ঘোষিত মুজিববর্ষে পৃথিবীজুড়ে নানান আয়োজনে তুলে ধরা হবে মুজিবাদর্শ। বাংলাদেশ যে অপার সম্ভাবনা ও সুযোগ-সুবিধার এক গতিশীল অর্থনীতির দেশ তাও উঠে আসবে এসব আয়োজনে। পাশাপাশি বাংলাদেশে বিভিন্ন আয়োজনে আসবেন বিশ্বনেতারা। বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাস মিশনগুলোর মাধ্যমে ২৬১টি অনুষ্ঠান আয়োজনের। এর মধ্যে নিউইয়র্ক ও লন্ডনে কনসার্টের মতো আয়োজন হবে। কিন্তু সব পাল্টে দেয় করোনাভাইরাস। বছরজুড়ে কূটনৈতিক কর্মকান্ড চলে ভার্চুয়ালি। ফোন ও ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমেই দূরে থেকে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখা হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে। এ বছর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ও ভারতের শীর্ষ সম্মেলনও হয় এই ভার্চুয়াল প্ল্যাটফরমে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বৈঠক করেন অনলাইনে।
জানা যায়, এ বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন, ইউনেস্কোর সাবেক মহাসচিব ইরিনা বুকোভা ও আরব লিগের সাবেক মহাসচিব আমর মুসা, ভারতের কংগ্রেস পার্টির গুরুত্বপূর্ণ নেতা সোনিয়া গান্ধী, বিজেপির নেতা ও ভারতের সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী এলকে আদভানি, জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ প্রমুখের বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ সফরের কথা ছিল। কিন্তু সব সফরই স্থগিত হয়ে যায়।
ঘটনাক্রম অনুসারে, বছরের শুরুতেই বিশ্বে বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি অবস্থানে রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান ভাগ হয়ে যেতে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ এক্ষেত্রে নিজেদের নিরপেক্ষ অবস্থান ঘোষণা করে কার্যকরভাবেই তা বজায় রাখে। বছরের প্রথম মাসে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর নয়াদিল্লি সফর বাতিল তৈরি করে নানান আলোচনা। অবশ্য এই সফর বাতিল করে তিনি আরব আমিরাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী আমিরাত সফর করেন ‘আবুধাবি সাসটেইন্যাবিলিটি উইক’ ও ‘জায়েদ সাসটেইন্যাবিলিটি প্রাইজ’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। সেখানে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বসে আলাদাভাবে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। প্রবাসীদের স্বার্থ রক্ষা ও সেবার ক্ষেত্রে দূতাবাসগুলোকে আন্তরিক হওয়ার কঠোর নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। বছরের প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর হিসেবে ফেব্রুয়ারিতে ইতালি যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস-আইসিজে) বিচারকরা সর্বসম্মত রায়ে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় মিয়ানমারকে হত্যা, নির্যাতন বন্ধ করাসহ জরুরি ভিত্তিতে চার দফা অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেন জানুয়ারি মাসেই। ডিসেম্বরে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয় রোহিঙ্গাদের একটি ব্যাচকে। জাতিসংঘসহ পশ্চিমা বিশ্বের সহায়তার বাইরে গিয়ে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশ। এর আগে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ঘিরে বিদেশি দূতাবাসগুলোর কর্মকান্ডের করা সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দূতাবাসের বাংলাদেশি কর্মীদের বিদেশি পর্যবেক্ষক করাকে গর্হিত অপরাধ বলে আখ্যা দিয়ে সংসদে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী।
জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে এসেই বিশ্বকে নাড়া দিতে শুরু করে করোনাভাইরাস। চীনের উহানে প্রাণঘাতী রূপ নেয় ভাইরাসটি। সেখানে আটকে পড়ে বাংলাদেশের প্রায় ৫ শতাধিক শিক্ষার্থী। তাদের ফিরিয়ে আনা নিয়ে তৈরি হয় উৎকণ্ঠা। তখনো ধারণা করা যায়নি এটি কতটা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। তবে চীনা নাগরিকদের নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও এক ধরনের উৎকণ্ঠা কাজ করতে থাকে। এর মধ্যেই জানুয়ারির শেষ দিকে উহান থেকে ফিরিয়ে আনা হয় আটকে পড়া বাংলাদেশিদের। ফেব্রুয়ারিতে প্রথম সিঙ্গাপুরে এক প্রবাসী বাংলাদেশির করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর আসে।
তবে কূটনৈতিক সফর বিনিময়ের ওপর কোনো প্রভাব ছিল না তখনো। বরং ফেব্রুয়ারির একেবারে শুরু থেকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মার্চে বাংলাদেশ সফরের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা বেগ পায়। মার্চের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা সফরে আসেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। ১৭ মার্চ মোদির সফরের ঘোষণা দেয় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগীর তথ্য পাওয়া যায়। বন্ধ হতে থাকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আয়োজন। স্থগিত হয় নরেন্দ্র মোদির সফর। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে করোনাভাইরাস আতঙ্কে প্রায় বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে বিশ্ব। বিশ্বের ছোট-বড় বেশির ভাগ দেশেই প্রবেশে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। কমতে থাকা এয়ারলাইনসগুলোর ফ্লাইট এবার একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় কূটনৈতিক সফর। শুরু হয় দূরে থেকেও কাছে থাকার কূটনীতি। অবশ্য করোনার মধ্যে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি হিসেবে আগস্টে ঢাকা আসেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব শ্রিংলা। পরে সেপ্টেম্বরে ঢাকা সফর করেন হাঙ্গেরির পররাষ্ট্রমন্ত্রী পিটার সিয়ার্তো। অক্টোবরে ঢাকা আসেন মার্কিন উপ-পররাষ্ট্র মন্ত্রী স্টিফেন ই বিগান।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন গত সেপ্টেম্বরে আঙ্কারায় নির্মিত বাংলাদেশের চ্যান্সেরি কমপ্লেক্সের উদ্বোধন করতে তুরস্ক গিয়েছিলেন। তখনই তুরস্কের চ্যান্সেরি কমপ্লেক্স উদ্বোধনের সময় তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানানো হয়। ডিসেম্বরে তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভুসগলু ঢাকা সফরে আসেন। গত নভেম্বরে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত দ্বীপরাষ্ট্র কমনওয়েলথ অব ডোমিনিকার সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। আগস্টে সেইন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। কুয়েতে বাংলাদেশের এমপি পাপুলের গ্রেফতার নিয়ে খানিকটা বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। অবশ্য এ নিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের কোনো ওঠানামা হয়নি। দুই দেশের সরকারের পক্ষ থেকেই কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। কুয়েতের আমির সাবাহ আল-আহমাদ আল-জাবের আল-সাবাহর মৃত্যুর পর সে দেশ সফর করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন। তিনি কুয়েতের নতুন আমির শেখ নাওয়াফ আল-আহমাদ আস-সাবাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আসেন।