নিউজ ডেস্ক: ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ অন্তত ১৯ বার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। অনেকে বলেন, সংখ্যাটি ২১। এগুলোর বেশির ভাগেই নিতান্ত ভাগ্যচক্রে বেঁচে যান তিনি। অনেক ক্ষেত্রে নেতাকর্মীরা জীবন বিলিয়ে দিয়ে তাকে রক্ষা করেন। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, যেখানে একাধিক দৈবক্রম তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
গ্রেনেড হামলা
২১ আগস্ট ২০০৪ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ের সামনে খোলা ট্রাকের অস্থায়ী মঞ্চে বক্তব্য দিচ্ছিলেন শেখ হাসিনা। বক্তব্য যখন শেষের পথে, তখন তাকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা চালায় ১২ জন জঙ্গি।
এ-সংক্রান্ত মামলায় সিআইডির তদন্ত এবং রিমান্ডে ও আদালতে আসামি মুফতি হান্নান, বুলবুল, জাহাঙ্গীর, বিপুলসহ বিভিন্ন জঙ্গির দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দলনেতা জান্দাল মঞ্চের সামনে প্রথম গ্রেনেডটি ছোড়েন। পরিকল্পনা ছিল, বিস্ফোরণের পর মঞ্চের সামনের জায়গা ফাঁকা হলে মঞ্চের কাছে অবস্থান নেয়া জঙ্গি বুলবুল গিয়ে সরাসরি মঞ্চে শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড ছুড়বেন।
প্রথম গ্রেনেডটি বিস্ফোরণের পর দিগ্বিদিক ছুটতে থাকা মানুষের ধাক্কায় পড়ে যান বুলবুল। ফলে তিনি আর গ্রেনেড ছুড়তে পারেননি। প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
এ সময় আরও একটি গ্রেনেড শেখ হাসিনাকে আঘাত করতে পারত। তিনি যখন বক্তব্য শেষ করে ট্রাক থেকে নামতে যাবেন, এক ফটো সাংবাদিক তাকে অনুরোধ করেন একটু দাঁড়াতে, যাতে তিনি ভালো ছবি নিতে পারেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা নামতে গিয়েও ডায়াসের কাছে ফিরে যান। ঠিক সেই সময় ট্রাক থেকে নামার পথে গ্রেনেড পড়ে। বেঁচে যান জাতির পিতার উত্তরসূরি।
এর পরপরই আরও বেশ কয়েকটি গ্রেনেড বিস্ফোরণ হয়। সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তা কর্মকর্তা এবং দলের নেতারা শেখ হাসিনাকে ঘিরে মানবঢাল তৈরি করেন। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে তাকে গাড়িতে তুলে সুধাসদনে নিয়ে যান। গাড়িতে তোলার সময় এবং ওঠার পরও গুলি চালানো হয় শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে। সেগুলো গায়ে না লাগায় জীবিত অবস্থায় সুধাসদনে ফিরতে পারেন তিনি।
সেদিন যারা মানবঢাল তৈরি করেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি মোহাম্মদ হানিফ, সাধারণ সম্পাদক (বর্তমানে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য) মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, নজীব উদ্দিন আহমেদ, নিরাপত্তা কর্মকর্তা তারেক আহমেদ সিদ্দিক, মেজর শোয়েব, আব্দুল্লাহ আল মামুন, শেখ হাসিনার দেহরক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রহমান। এর মধ্যে মাহবুবকে গ্রেনেড সরাসরি আঘাত করায় তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান। আর মাথায় আঘাত পাওয়া মেয়র মোহাম্মদ হানিফ পরে মারা যান।
সেদিন ঘটনাস্থলে আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভী রহমান, আবুল কালাম আজাদ, রেজিনা বেগম, নাসির উদ্দিন সরদার, আতিক সরকার, আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারি, আমিনুল ইসলাম মোয়াজ্জেম, বেলাল হোসেন, মামুন মৃধা, রতন শিকদার, লিটন মুনশী, হাসিনা মমতাজ রিনা, সুফিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), মোশতাক আহমেদ সেন্টু, মোহাম্মদ হানিফ, আবুল কাশেম, জাহেদ আলী, মোমেন আলী, এম শামসুদ্দিন এবং ইসাহাক মিয়া মৃত্যুবরণ করেন।
আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম দৈনিক বাংলাকে জানান, বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়ামাত্র তারা শেখ হাসিনাকে ঘিরে দাঁড়ান। মানবঢাল বানিয়ে তাকে গাড়িতে তোলা হয়।
লালদীঘির ময়দানে গুলি
১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি সরকারবিরোধী একটি সমাবেশের ডাক দেয়া হয় চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ট্রাকবহর নিয়ে আওয়ামী লীগের একটি মিছিল লালদীঘি মাঠে যাচ্ছিল। মিছিলটি পুরোনো বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের সামনে পৌঁছালে তখনকার পুলিশ কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদার নির্দেশে নির্বিচারে গুলি ছুড়তে শুরু করে পুলিশ। এতে শেখ হাসিনা প্রাণে রক্ষা পেলেও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও সাধারণ পথচারীসহ ২৪ জন মারা যান। আহত হন অন্তত ২০০ জন।
ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন দৈনিক বাংলাকে জানান, তিনিসহ উপস্থিত আওয়ামী লীগ নেতারা ট্রাক থেকে শেখ হাসিনাকে নামিয়ে নিরাপদে সরিয়ে নিতে সক্ষম হন। ফলে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুকন্যা।
১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারির ওই ঘটনায় যে ২৪ জন নিহত হয়েছিলেন তারা হলেন- হাসান মুরাদ, মহিউদ্দিন শামীম. স্বপন কুমার বিশ্বাস, এলবার্ট গোমেজ কিশোর, স্বপন চৌধুরী, অজিত সরকার, রমেশ বৈদ্য, বদরুল আলম, ডি কে চৌধুরী, সাজ্জাদ হোসেন, আবদুল মান্নান, সবুজ হোসেন, কামাল হোসেন, বি কে দাশ, পঙ্কজ বৈদ্য, বাহার উদ্দিন, চান্দ মিয়া, মসর দত্ত, হাশেম মিয়া, মো. কাশেম, পলাশ দত্ত, আবদুল কুদ্দুস, গোবিন্দ দাশ ও মো. শাহাদাত।
কোটালীপাড়ায় বোমা
২০০০ সালের ২২ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার শেখ লুৎফর রহমান সরকারি আদর্শ কলেজ মাঠে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশ করার কথা ছিল। ওই সমাবেশের প্যান্ডেল তৈরির সময়ে সন্ত্রাসীরা প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করার জন্য দুটি শক্তিশালী বোমা পুঁতে রাখে।
স্থানীয় এক চায়ের দোকানদারের দেয়া তথ্যে মাটির নিচে পোঁতা তারের সূত্র ধরে সেনাবাহিনীর বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা ২০০০ সালের ২০ জুলাই ওই কলেজের পাশ থেকে ৭৬ কেজি ও ২৩ জুলাই হেলিপ্যাডের কাছ থেকে ৪০ কেজি ওজনের দুটি শক্তিশালী বোমা উদ্ধার করে।
যে বোমাটি মাটির নিচে পুঁতে রাখা হয়েছিল, সেটির তার মাটির নিচ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলেও সেটির একটি অংশ চায়ের দোকানের পাশে মাটির ওপরে ভেসে থাকতে দেখেন ওই দোকানি।
সাবজেলে স্লো পয়জনিং
২০০৭ সালে ‘ওয়ান-ইলাভেন’ পরবর্তী সময় সাবজেলে বন্দি থাকা অবস্থায় খাবারে বিষ প্রয়োগ করে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ওই খাবার খেয়ে তার চোখমুখ ফুলে গিয়েছিল এবং তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বলে আওয়ামী লীগ নেতারা বিভিন্ন সময় অভিযোগ করেন।
২০০৯ সালের ২৭ জুন রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী অভিযোগ করে বলেন, কারাগারের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা নারী কারারক্ষীদের কাছ থেকে বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টার বিষয়টি তিনি অবগত হন এবং বিষয়টি শেখ হাসিনাকে জানান। এরপর শেখ হাসিনা কারাগারে চিড়া, মুড়ি ও কলা খেয়ে থাকতেন।
ধানমন্ডি ৩২
১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট মধ্যরাতে ফ্রিডম পার্টির অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী কাজল ও কবিরের নেতৃত্বে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে গুলি ও গ্রেনেড ছোড়া হয়। শেখ হাসিনা তখন ওই বাড়িতে প্রবেশ করছিলেন। সঙ্গে থাকা নিরাপত্তারক্ষী এবং নেতাকর্মীদের প্রতিরোধে শেষ পর্যন্ত সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। মামলায় ফ্রিডম পার্টির সদস্য কাজল ও কবিরের নেতৃত্বে ১০-১২ জনের একটি দল ৩২ নম্বরের বাড়িতে অতর্কিতে গুলিবর্ষণ ও বোমা হামলা করে এবং হামলাকারীরা তখন ‘কর্নেল ফারুক-রশিদ জিন্দাবাদ’ বলে স্লোগান দিতে দিতে পালিয়ে যায়।
অন্যান্য হত্যাচেষ্টা
১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর চতুর্থ জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনের সময় ধানমন্ডির গ্রিন রোডে ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনে গেলে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। তার গাড়িতে গুলি লাগলেও অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান তিনি।
১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ‘ট্রেনমার্চ’ করার সময় পাবনার ঈশ্বরদী রেলস্টেশনে শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রেনের বগি লক্ষ্য করে বেশ কিছু গুলি করা হয়। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে অক্ষত থাকেন শেখ হাসিনা।
১৯৯৫ সালের ৭ মার্চ শেখ রাসেল স্কয়ারে সমাবেশে ভাষণ দেয়ার সময় শেখ হাসিনার ওপর হামলা চালানো হয়। সশস্ত্র ওই হামলা থেকে বাঁচাতে নেতাকর্মীরা তাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেন।
১৯৯৬ সালের ৭ মার্চ সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা বক্তৃতা করছিলেন। এ সময় হঠাৎ করে একটি মাইক্রোবাস থেকে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলি ও বোমা ছোড়া হয়। এতে কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২ এপ্রিল বরিশালের গৌরনদীতে শেখ হাসিনার গাড়িবহরে গুলি করে দুর্বৃত্তরা।
এর পাশাপাশি নওগাঁ এবং সাতক্ষীরায় গুলিবর্ষণ করে এবং সিলেটে বোমা পুঁতে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়।