নিউজ ডেস্ক : রাত নয়টা বাজার ১০ মিনিট আগে সদরঘাট পৌঁছে যখন বেশ আয়েশি ভঙিতে ঘাটে প্রবেশ করছি, তখনই জানলাম বরিশালের শেষ লঞ্চ ছাড়ে রাত নয়টায়। ততক্ষনে দলের দুই সদস্য ঘাটে না ঢুকে এটিএম বুথ খুঁজতে গিয়েছেন। টাকা ছাড়া এই দীর্ঘ সফর তারা করতে পারবেন না। কিন্তু টাকা তোলার সুযোগ কই যখন বরিশাল না যাওয়ার উপক্রম খোদ বুড়িগঙ্গার ধারেই।
পড়িমরি করে রাত নয়টা বাজার দুই মিনিট আগে সুন্দরবন ১০ লঞ্চের তিন তলার নদীমুখে কেবিনে উঠে বসলাম। আমাদের দলে পাঁচজন। দুই কেবিনে আয়েশ করে যাওয়া যাবে। এক সময় বরিশালের লঞ্চে কেবিন পাওয়া আর সোনার চাঁদ হাতে পাওয়া একইরকম ছিল। পদ্মা সেতু হওয়ার পর লঞ্চের সে দাপট বুড়িগঙ্গার পানির সঙ্গে মিশে গেছে। আগে এসে মুলোমুলি করলে নির্ধারিত দরের চেয়ে কমও পাওয়া যায় এখন।
আমাদের গন্তব্য ঝালকাঠির ভিমরুলির পেয়ারার বাজার আর আশপাশের বাগান। পাঁচজনের একজনেরও সেখানে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। দুজনের তো লঞ্চে চড়ারই অভিজ্ঞতা নেই। এমন আনাড়ি লোকজন নিয়ে লঞ্চে উঠে যতটা না টেনশনের তার চেয়ে বেশি ভয় তাদের নানা রকম আজগুবি প্রশ্নে। ফট করে কখন কী জিজ্ঞেস করে তা একটা আতঙ্কের মতো বিষয়। লঞ্চে যাওয়ার সময় সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন-‘ভাই এই নদীর নাম কী?’ কারণ নদীর আশপাশে কোনো সাইনবোর্ড থাকে না যে, এটা থেকে বলা যাবে এই নদীর নাম মেঘনা, পদ্মা নাকি কীর্তনখোলা।
চাঁদ যাত্রা
ঠিক সময়ে লঞ্চ ছাড়ার পর পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠেলো। না, বমি হওয়ার ভয় নাই। রাতে কেউই খেয়ে উঠিনি। তাই পেটের দায়িত্ব দিতে হলো কেবিন বয়দের হাতে। খানিক পরে রূঁপচাদা মাছ, বেগুন ভাজি, ডাল চচ্চরি, আলু ও কলা ভর্তা, সালাদ আর গরম ভাত হাজির হলো। সেটা পেটে চালান করে গরম চা। লঞ্চের বারান্দায় বসে সেই ধোয়া ওঠা চা খেতে খেতে নিজেকে রাজ্যের সুখী মানুষ ভাবা যায়। আর যদি আকাশে চাঁদ থাকে আর সেই চাঁদের আলো বিশালকার নদীর জলে পড়ে এবং সেটা যদি একবার আপনি উপলব্ধি করতে পারেন, তাহলে আপনি চাইবেন পৃথিবী এখানে থেমে যাক।
কিন্তু আমাদের যাত্রা তো বরিশাল। চাঁদের সঙ্গে গল্প করতে করতে আমরা ভোরের দিকে পৌঁছালাম বরিশাল। সেখান থেকে মাহিন্দ্রতে (টেম্পুর মতো গাড়ি) ঘন্টখানেকের জার্নি শেষে বরিশালের বানাড়িপাড়া লঞ্চ ঘাটে। সেখানে গিয়ে সকালের নাস্তা সেরে চেপে বসলাম ট্রলারে। যে ট্রলার আমাদের নিয়ে যাবে ভিমরুলির ভাসমান পেয়ারা বাজারে। সন্ধ্যা নদী থেকে ১০টার খানিক আগে ছাড়লো ট্রলার। অদ্ভত সুন্দর এই নদীর চারপাশ। কিছুদূর গিয়ে ঢুকে গেলে এক খালে। এ খালের দুই পাশে আমড়া, কলার বাগানসহ নানা ধরনের গাছ। যে গাছের ছায়া মাড়িয়ে আমাদের ট্রলার এগিয়ে যাচ্ছে। এবার ট্রলার ঢুকে গেল আরও একটু ছোট খালে। খাল থেকে সরু আকারের ডিঙি নৌকা চলার মতো আরও অসংখ্য খাল ঢুকে গেছে বাগানের ভেতর, গ্রামের মধ্যে।
পেয়ারার রাজ্যে
আমরা যখন ভিমরুলিতে পৌঁছাই তখন বেলা সাড়ে এগারোটা ছুঁইছুঁই। অবশ্য বাজার পাওয়ার আগেই আমাদের অভিবাদন জানায় পেয়ারা বাগান আর সেই বাগান থেকে হেলতে দুলতে বের হতে থাকা পেয়ারা বোঝাই ডিঙি নৌকা। ভিমরুলি বাজারের দুই পাশ যুক্ত করেছে একটা সেতু। সেই সেতু ঘিরেই মূলত বাজার। আশপাশের অসংখ্য পেয়ারা চাষী পেয়ারা বোঝাই নৌকা নিয়ে হাজির হয়েছেন। পুরো বাজারটাই খালের ওপর ভাসমান। পাইকাররা দামদর করছেন, ডিঙি থেকে সেগুলো নিচ্ছেন নিজেদের বড় নৌকায়। সকাল থেকে বেলা ১২ টা অবধি চলে এই বাজারের কেনাকাটা। তবে কেউ চাইলে নিজের বাসার জন্য পেয়ারা কিনতে পারবেন। বেশ কিছু ব্যবসায়ী পর্যটকদের জন্য নৌকায় পেয়ারা ও আমড়া নিয়ে ঘোরেন।।
বাজার ঘুরে আমাদের গন্তব্য পাশেই গড়ে তোলা গৌরব পেয়ারা পার্ক। কয়েক একর জায়গা জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে এই পার্ক। পার্কের প্রবেশ মূল্য ৪০ টাকা। ঘুরে দেখার পাশাপাশি পেয়ারা খাওয়া যায় ইচ্ছামতো। কিন্তু বাইরে আনা যাবে না। বেয়াড়াদের জন্য নয়, সবার জন্য পেয়ারা একেবারে ফ্রি।
ভেতরে ঢুকে পেট পুরে পেয়ারা খেয়ে ঘন্টাখানেক আড্ডা দিয়ে বের হলাম আমরা। কিন্তু পেয়ারা দিয়ে আর যাই হোক ‘লাঞ্চ’ হবে না। তাই বাধ্য হয়ে বাজারের পাশের ‘বৌদির হোটেল’ ভরসা। এই হোটেলের নামডাক আগে থেকেই শুনে এসেছি। খালের কোল ঘেসে ভাসমান এ হোটেল নানারকম মাছ আর দেশী মুরগী পাওয়া যায়। যারা এই হোটেলে যাবেন সন্ধ্যা নদীর ইলিশ এবং মিষ্টি খেতে ভুলবেন না।
সত্যিকারের পেট পুজা সেরে ফিরতি পথ ধরলাম। একদিনের সবচেয়ে আরামদায়ক ভ্রমণ এই ভিমরুলি পেয়ারা বাজার। পথের ক্লান্তি পথে দূর হযে যাবে যেমন তেমনি মন আর শরীর চাঙা হয়ে উঠবে নতুন জায়গা ভ্রমণে।