প্রভাষ আমিন: প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রথম আলোর প্রাথমিক দ্বিধার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। হতে পারে প্রথম দিকে তারা রোজিনার দায় নিতে চায়নি। দায় না নেয়ার অতীত উদাহরণ অবশ্য প্রথম আলোর আছে। ১/১১-এর সময় প্রথম আলোর রম্য ম্যাগাজিন আলপিনে কার্টুন ছাপার অপরাধে কার্টুনিস্ট আরিফকে কারাগারে যেতে হয়েছিল। আরিফ কার্টুন আঁকতে পারে। কিন্তু যারা ছেপেছিল, দায় তো তাদের। কিন্তু তারা কেউ দায় নেননি। হুজুরদের কাছে তওবা করে, আর কার্টুনিস্ট আরিফকে ভুলে গিয়ে প্রথম আলো নিজেদের বিপদ থেকে উদ্ধার করেছিল।
আর প্রথম আলো পাশে দাঁড়ায়নি বলে সেই তরুণ কার্টুনিস্টকে শেষ পর্যন্ত দেশ ছাড়তে হয়েছিল। হুজুরদের ভয়ে প্রকাশ্যে প্রথম আলো হয়তো সেই কার্টুনিস্টের পাশে দাঁড়াতে পারেনি। কিন্তু চাইলে গোপনে তাকে সাহায্য করতে পারতো। তওবা করা, মুচলেকা দেওয়া, সত্য রিপোর্ট করেও আদালতে গিয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে আসার ইতিহাস প্রথম আলোর অনেক আছে।
শুধু প্রথম আলো নয়, রোজিনা ইস্যুতে শুরুতে দ্বিধা ছিল আমাদের সাংবাদিক নেতাদেরও। অবশ্যই সবার আগে প্রথম আলোর ছুটে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু প্রেসক্লাব থেকে সিনিয়র সাংবাদিক ও নেতারা যদি দ্রুততম সময়ে সচিবালয়ে ছুটে যেতেন, তাহলে ঘটনাটি সেখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো। রোজিনার ফোন কেড়ে নেওয়া হয়েছিল বলে তিনি ঊর্ধ্বতন কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি। কিন্তু প্রথম আলোর সিনিয়র কেউ বা সিনিয়র নেতারা শুরুতে উদ্যোগ নিলে বিষয়টি হয়তো এতদূর গড়াতো না। কিন্তু প্রথম কোনো সিনিয়র নেতাকে সক্রিয় দেখা যায়নি। নেতারা হয়তো লাভ-ক্ষতির হিসাব কষছিলেন- আন্দোলন করতে গেলে সরকার মাইন্ড করে কি না, সুযোগ-সুবিধা কমে যায় কি না, প্রথম আলোর পাশে দাঁড়াবো কি না ইত্যাদি ইত্যাদি দ্বিধার বেড়ি হয়তো তাতের আটকে রেখেছিল।
এই দ্বিধারও একটা ব্যাখ্যা আছে। প্রথম আলোর ব্যাপারে অনেকেরই অনেক রকম দ্বিধা আছে। আজ প্রথম আলোর একজন সিনিয়র রিপোর্টারের পেছনে গোটা সাংবাদিক সমাজ ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু রিপোর্টারটি যদি প্রথম আলোর না হয়ে ভোরের আলোর হতো, প্রথম আলোতে তা এক লাইনও ছাপা হতো না। অতীতে অনেকবার দেখা গেছে, বিভিন্ন ইস্যুতে সাংবাদিকরা আন্দোলন-সংগ্রাম করলেও প্রথম আলো নির্বিকার থেকেছে। আজ যখন বিষয়টি তাদের ঘাড়ে এসেছে এবং রোজিনা ইস্যুকে ব্যবহার করে প্রথম আলো ক্রেডিট নিতে পারবে; এটা নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল প্রথম আলো সক্রিয় হয়েছে। ঘটনা উল্টো হলে প্রথম আলো মুচলেকা দিয়ে রোজিনাকে ছুঁড়ে ফেলতে দ্বিধা করতো না। প্রথম আলো সবসময় নিজেদের ‘ব্রাহ্মণ’ ভাবে। অন্যদের তারা পাত্তাই দেয় না।
সাংবাদিকদের কোনো সংগঠনেই প্রথম আলোর অংশগ্রহণ নেই। প্রথম আলোর কেউই সাংবাদিকদের কোনো সংগঠনে কখনো নির্বাচন করতে পারে না। কিন্তু আজ প্রথম আলোর বিপদকে ‘নমশুদ্র সাংবাদিকরা’ নিজেদের বিপদ মনে করে এগিয়ে এসেছে। তবে এই এগিয়ে আসাটাও সম্ভব হয়েছে তারুণ্যের স্বতঃস্ফূর্ততায়। সচিবালয়ে, শাহবাগ থানায় তরুণ সাংবাদিকরাই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ করেছে। কারণ তাদের লাভ-ক্ষতির হিসাব নেই। তারুণ্য শুধু একজন সাংবাদিকের বিপদের কথাই ভেবেছে। তিনি রোজিনা ইমলাম, নাকি প্রথম আলো সেটা তারা ভাবেনি। তারুণ্য আন্দোলনটা শুরু করেছে বলেই প্রথম আলো এগিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে, সিনিয়র নেতারা মাঠে নেমেছেন। আমিও শেষ পর্যন্ত ভরসা রাখতে চাই তারুণ্যেই। রোজিনার মামলা প্রত্যাহারের দাবির পাশাপাশি পেশাগত কাজে সকল সাংবাদিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লড়াইটা তাদেরই চালিয়ে যেতে হবে।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।