ঔপনিবেশিক শাসন হতে মুক্তি এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী সংস্কারের যৌথ অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ এবং ভারতের সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। পাঁচ দশক পরে, সংহতি এবং অভিন্ন জ্ঞানের চেতনা আমাদের উন্নয়ন সহযোগিতার ভিত্তিতে পরিণত হয়েছে। এর প্রমাণ হলো, বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য উভয় দেশের মধ্যে ৭.৮ মিলিয়ন ডলারের সহজ শর্তের ঋণচুক্তি বা ক্রেডিট লাইন রয়েছে, যা যে অন্য কোনও দেশের চেয়ে বেশি।
অতীতে, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে গ্লোবাল সাউথ বা “তৃতীয় বিশ্ব” হিসেবে দেখা হত এবং অন্যদের দাক্ষিণ্যের শিকার হতে হতো। তবুও, সাম্য, সার্বভৌমত্বের জন্য পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা আমাদের দক্ষিণাঞ্চলের সহযোগিতার প্রয়োজনীয় শর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১০ এর দিকে ভারত বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য সহজ শর্তে ঋণ দিতে শুরু করে। তখন থেকে বাংলাদেশ ও ভারত ৪৬টি অবকাঠামো প্রকল্পে অংশীদার হয়েছে, যার মধ্যে ১৪টি সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে- ১৭টি রেল প্রকল্প যার মধ্যে ৯টি সম্পন্ন হয়েছে, আটটি সড়ক (৩টি সমাপ্ত), পাঁচটি বন্দর (১টি সমাপ্ত) এবং বাংলাদেশের একটি বিমানবন্দর। এছাড়াও তিনটি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন প্রকল্প এবং একটি টেলিকম প্রকল্প রয়েছে। রূপপুরে বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে এই সঞ্চালন লাইনগুলো স্থাপন করা হয়েছিল।
বাংলাদেশ তার আর্থ-সামাজিক সূচকগুলোকে আরও ভাল করতে ঋণ চুক্তিগুলোকে দক্ষতার সাথে ব্যবহার করেছে। এটি স্থানীয় আয়, কর্মসংস্থান এবং স্বয়ংসম্পূর্ণতা তৈরিতে সহায়তা করেছে। মানব উন্নয়নের মাপকাঠিতে বাংলাদেশ সাক্ষরতার হার এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্য সূচককে উন্নত করতে সফল হয়েছে- গড় আয়ু বেড়ে ৭২ বছর হয়েছে, যেখানে ভারতীয়দের গড় আয়ু ৬৮ বছর এবং পাকিস্তানিদের ৬৬ বছর। এমনকি মহামারী চলাকালীন বাংলাদেশ স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রেখেছে। শেখ হাসিনা এবং নরেন্দ্র মোদী উভয়ই প্রতিবেশীদের অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
উভয় দেশের অর্থনীতিকে জোরদার করার জন্য সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা ভাগ করে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারত রেলওয়ে অবকাঠামো, দ্বিতীয় ভৈরব সেতু, ব্রডগেজ লোকোমোটিভসহ ১২০টি যাত্রীবাহী রেল কোচ, ১০টি ব্রডগেজ ডিজেল-বৈদ্যুতিক লোকোমোটিভ ও বিভিন্ন প্রকল্পে বাংলাদেশকে সহায়তা করেছে। এই চুক্তি ছিল পারস্পরিক সুবিধার লক্ষ্যে। ভারত বাংলাদেশের মাধ্যমে পণ্য পরিবহণ করতে পারছে; একই সাথে বর্ধিত সংযোগের কারণে ভারত, ভুটান এবং নেপালের সাথে বাংলাদেশের আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য সম্প্রসারিত হতে পারে।
তবে ভারতের পক্ষে উন্নয়ন সহযোগিতার ধারণাটি তার স্বাধীনতা পরবর্তী অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত হয়েছে। সহযোগিতার প্রথম উদাহরণটি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম। ভারত বুদ্ধিবৃত্তিক ও বৈষয়িক সম্পদ উভয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সমর্থন করেছিল। তবে সমৃদ্ধির পথ ছিল প্রতিকূল। বাংলাদেশ ও ভারত তাদের নিজ নিজ দখলদারদের দ্বারা অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে পড়েছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিশ্বের জিডিপিতে মাত্র ৩ শতাংশ অবদান রেখেছিল।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পরিচালিত যুদ্ধ বাংলাদেশকে বিধ্বস্ত করেছিল এবং এর প্রবৃদ্ধির হার ছিল বিশ্বের জিডিপির মাত্র ০.০৩ শতাংশ প্রায়। ১৯৫০ এর দশকে ভারত অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য ফ্রান্স, জার্মানি এবং জাপানের মতো দেশগুলির সহায়তা পেয়েছিল। দিল্লীর ম্যাস র্যাপিড ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম, ডেডিকেটেড ফ্রেইট করিডোর, কলকাতা পূর্ব-পশ্চিম মেট্রো প্রকল্প, শুগ্টং-কারচাম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প-এইচপি ইত্যাদির মতো প্রকল্পগুলি পশ্চিমের কয়েকটি দেশের সহায়তায় হয়েছিল, যা ভারতের উন্নয়ন যাত্রায় গতি সঞ্চার করেছিল।
১৯৬৪ সালে উদীয়মান দেশগুলিকে দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত বিকাশের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করার জন্য ভারতীয় প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা (আইটিইসি) কার্যক্রম শুরু করা হয়েছিল। এরপর থেকে ভারত আইটিইসি প্রকল্পের আওতায় ১৮৫টি ফেলোশিপ প্রদান করেছে এবং ৪১৪ জন বাংলাদেশী সরকারী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
উন্নয়ন অংশীদারিত্ব সম্প্রসারণ ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের উপকারের জন্য, উভয় দেশ অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলি সম্পন্ন করার জন্য আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতি সহজ করেছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নিয়মিত সংলাপ অব্যাহত রয়েছে যা প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত করতে এবং সম্পদের অপচয় সীমাবদ্ধ করার নিশ্চিত পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করছে।
এছাড়াও, শতাব্দী পুরনো ঐতিহাসিক এবং বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়ে বাংলাদেশ এবং ভারত একসাথে বিশ্বের ৬.৩ বিলিয়ন মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। উন্নয়নের সহযাত্রী হওয়ার কারণে আমরা সম্পদের ভারসাম্যহীনতা, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বিকশিত প্রযুক্তির মুখোমুখি হই। টেকসই দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রবৃদ্ধির জন্য, বাংলাদেশ এবং ভারত সহযোগিতা সম্প্রসারণ এবং তাদের উন্নয়নের লক্ষ্য পূরণের জন্য সঠিক পথে রয়েছে।
লেখক : এম এ আমিন রিংকু, গণমাধ্যমকর্মী