নিজস্ব প্রতিবেদক
দেশে গত কয়েক দিন প্রধান কয়েকটি ভোগ্যপণ্যের বাজারদর ছিল কমতির দিকে। এর মধ্যেই জ্বালানি তেলের দরবৃদ্ধি ও মুদ্রাবাজারে ডলারের ঊর্ধ্বগতিতে আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার। গত কয়েক দিনে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি, আটা, ময়দাসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।
দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ। এখানকার চাক্তাই, আছদগঞ্জ, খাতুনগঞ্জ ও বক্সিরহাটের আড়ত ছাড়াও চট্টগ্রামের পাহাড়তলী এলাকার পাইকারি বাজারগুলোয় প্রধান প্রধান ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান ও আড়তদার ব্যবসায়ীরা। প্রধানত দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চালসহ বিভিন্ন পণ্য পরিবহনে বাড়তি ভাড়া বাড়ায় পণ্যগুলোর দামও বেড়েছে বলে জানিয়েছেন তারা।
খাতুনগঞ্জসহ চট্টগ্রামের পাইকারি বাজারগুলোয় চাল, চিনি, আটা-ময়দা, ভোজ্যতেল, ডালসহ বিভিন্ন পণ্যের মণপ্রতি দাম বেড়েছে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। এর মধ্যে উৎসভেদে গমের দাম বেড়েছে সর্বোচ্চ ১০০ টাকা পর্যন্ত। বাজারে বর্তমানে প্রতি মণ (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) কানাডীয় গম বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ১০০ থেকে ২ হাজার ১৫০ টাকায়, ভারতীয় গম বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি ১ হাজার ৬২০ থেকে ১ হাজার ৬৫০ টাকায়। চিনির দামও বেড়েছে মণপ্রতি ১০০ টাকা পর্যন্ত। বাজারে এখন প্রতি মণ চিনি বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৯৩০ থেকে ২ হাজার ৯৫০ টাকায়।
পাইকারি বাজারে চাল ও ভোজ্যতেলের দাম আগে থেকেই ঊর্ধ্বমুখী ছিল। জ্বালানি তেলের দরবৃদ্ধিতে যানবাহন ভাড়া বাড়ায় পণ্য দুটির নতুন করে দাম বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। গত কয়েক দিনে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে মণে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। বর্তমানে প্রতি মণ খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৭ হাজার টাকায়, সুপার পাম অয়েল ৬ হাজার ও পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার ৮০০ থেকে ৫ হাজার ২০০ টাকায়। পাশাপাশি উত্তরবঙ্গ থেকে চাল পরিবহনে খরচ বেড়ে যাওয়ায় বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) দাম ৬০ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
খাতুনগঞ্জের ট্রেডিং ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, পাইকারি বাজারে যে ধরনের পণ্য লেনদেন হয় তার সবগুলোর সঙ্গেই পরিবহন ভাড়ার বিষয়টির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। খাতুনগঞ্জসহ বিভিন্ন পাইকারি বাজারে এসও, স্লিপ বা ট্রেডিং বাণিজ্য দেখা যায় সবচেয়ে বেশি। কিন্তু জ্বালানি তেলের দরবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় পণ্য পরিবহনের ভাড়াও বেড়ে গিয়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে এখন সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে।
বিভিন্ন ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত একটি ট্রাক কিংবা কাভার্ড ভ্যান যেতে ৪০ লিটার ডিজেল প্রয়োজন হয়। বর্তমানে ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা করা হয়েছে। এতে একটি যানবাহনে অতিরিক্ত ১ হাজার ৩৬০ টাকা বাড়তি খরচ যুক্ত হয়েছে। কিন্তু সরকারিভাবে পণ্য পরিবহনের বিভিন্ন যানবাহনের ভাড়া নির্ধারিত না হওয়ায় পরিবহন মালিকরা কয়েক গুণ বেশি বাড়তি খরচ যুক্ত করেছেন, যার প্রভাব পড়েছে পণ্যের বাজারে। বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম কিংবা উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে চট্টগ্রামে পণ্য পরিবহনে ৫ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত বেশি ভাড়া নিচ্ছেন মালিকরা। এতে পণ্যের দামের ওপর প্রভাব পড়ে ভোগ্যপণ্যের বাজারে হঠাৎ করেই নতুন অস্থিরতা তৈরি হয়েছে
, জ্বালানি তেলের দাম হঠাৎ করেই বাড়িয়ে দেয়ায় পরিবহন মালিকরা বেশি ভাড়া হাঁকছেন। এ কারণে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পণ্যবাহী যানবাহনের সংখ্যা কমে গিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে ট্রাক কিংবা কাভার্ড ভ্যান না আসায় পণ্য নিয়ে যাওয়ার যানবাহনের সংখ্যাও কমে গিয়েছে। এতে ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় বিক্রি কমে গিয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ। দ্রুত সময়ের মধ্যে পণ্যবাহী যানবাহনের ভাড়া নির্ধারণ করা হলে পণ্যের দামের অস্থিরতা কমে আসবে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, চট্টগ্রাম থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পণ্য পরিবহনে স্কেলভিত্তিক বাধা রয়েছে। ১৩ টনের বেশি পণ্য পরিবহন করা যায় না। এ কারণে ভাড়া বেড়ে গেলে পণ্যের দামও অতিরিক্ত বেড়ে যায়। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে নিয়মমাফিক পণ্যের ওপর কেজিপ্রতি ৫০ থেকে ৭৫ পয়সা অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধির কথা থাকলেও নানা হাত ঘুরে পাইকারি বাজারে দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ১-২ টাকা। খুচরা বাজারে গিয়ে একই পণ্যের দাম আরো বেড়ে যাচ্ছে।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে, কভিডের প্রাদুর্ভাব-পরবর্তী সময়ে দেশে ভোজ্যতেলের বাজার অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে। বর্তমানে বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দরপতন অব্যাহত থাকলেও দেশের বাজারে এর কোনো প্রতিফলন নেই। সম্প্রতি ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ২০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে ভোজ্যতেল মোড়কজাতকারী কোম্পানিগুলোর সংগঠন। দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ার সুযোগে এরই মধ্যে পাইকারি বাজারে সব ধরনের খোলা ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে গিয়েছে। এ অবস্থায় মোড়কজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সয়াবিন তেলের দাম ফের বাড়ানোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সরকারিভাবে এখনো দাম পুনর্নির্ধারণ করা না হলেও পাইকারি ও খুচরা বাজারে মোড়কের অতিরিক্ত দামে ভোজ্যতেল বিক্রির অভিযোগ উঠেছে।
আমদানিকারকরা সাধারণত কয়েক মাস আগের আনা ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ করে বাজারজাত করেন। বিভিন্ন সময় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আলোচনার সময় ব্যবসায়ীরাই এমন তথ্য জানিয়েছেন। সে হিসেবে বিশ্ববাজারে এক সপ্তাহের সাময়িক দরবৃদ্ধির অজুহাতে দেশেও ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবটি গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
তারা বলছেন, দেশে ভোগ্যপণ্যের দাম অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চে। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে চীন-তাইওয়ান উত্তেজনাকে সামনে রেখে বৈশ্বিক পণ্যবাজারও নতুন অস্থিরতার দিকে রয়েছে। তবে ইউক্রেনের বন্দর দিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি শস্যবাহী জাহাজ বিশ্বের বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যাওয়ার পর বৈশ্বিক শস্যবাজার কিছুটা স্থিতিশীল হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি ও বিদ্যুৎ সংকট দেশের বাজারকে নতুন করে অস্থিরতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।