ডিবিসি জার্নাল নিউজ ডেস্ক: রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আয়েন উদ্দিনের বিরুদ্ধে দলীয় নেতাকর্মীদের নির্যাতনসহ নানা অভিযোগ জমা পড়েছে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে। অন্য যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, জমি দখল, মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে গ্রেপ্তার করানো, নিয়োগ বাণিজ্য প্রভৃতি।
সর্বশেষ লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী হাছান মাহ্মুদের কাছে। এ অভিযোগ করেছেন পবা-মোহনপুরের আওয়ামী লীগ এবং যুবলীগের নেতাকর্মীরা।
গত শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে এ অভিযোগ দেওয়া হয়।
এ অভিযোগে এলাকার ১৬ জন নেতাকর্মী উল্লেখ করেন, দলীয় ত্যাগী নেতারা এমপির কাছে নানাভাবে নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। শত শত কৃষকের জমি দখল করে নিয়ে পুকুর খনন ও বাগানবাড়ি নির্মাণ করেছেন। বিল দখলে নিয়ে পুকুর করায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন মৎস্যজীবীরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে জামায়াত-বিএনপিপন্থীদের চাকরি দিয়েছেন। এ ছাড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি নানা ধরনের কটূক্তি, মাদক কারবারিদের পৃষ্ঠপোষকতাও করেন তিনি।
লিখিত অভিযোগে সই করেছেন মোহনপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সুলতান আলী, কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক জমসেদ আলী, মোহনপুর মহিলা যুবলীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও ঘাসিগ্রাম ইউনিয়নের নারী সদস্য হাবিবা খাতুন, যুবলীগের সহসভাপতি আলমগীর হোসেন, রায়ঘাটি ইউনিয়ন কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক সূর্যকান্ত হালদার প্রমুখ।
অভিযোগে বলা হয়, গত ২২ জুলাই কৃষক লীগের নেত্রী হাবিবা খাতুনকে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করান এমপি। এমপির জমি দখল নিয়ে একটি গণমাধ্যমে হাবিবা বক্তব্য দেওয়ার পরে তাঁকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। পরে একটি মিথ্যা মামলায় জেলহাজতেও পাঠানো হয়। জামিনে বের হয়ে গত ২৭ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করে এমপির বিচার দাবি করেন হাবিবা।
হাবিবা বলেন, ‘বিলকুমারী বিলের পাশে তুলসিক্ষেত্র এলাকায় শতাধিক কৃষকের জমি দখল করে এমপি আলিশান বাড়ি আর পুকুর গড়ে তুলেছেন। গত ৯ বছরে তিনি শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। এ নিয়ে অভিযোগ করায় আমাকে গোয়েন্দা পুলিশ দিয়ে তুলে নিয়ে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়। ’
এর আগে এমপির বাহিনী রায়ঘাটি ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলামকে পিটিয়ে আহত করে বলে অভিযোগ ওঠে। হুমকির মুখে আতঙ্কিত জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও মোহনপুর উপজেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি সুরঞ্জিত সরকার। তিনি বিভিন্ন সময়ে এমপির বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, জমি দখল, নেতাকর্মীদের মারপিট, নির্যাতন, মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসানো, সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ তুলে সংবাদ সম্মেলনও করেছিলেন।
শহিদুল ইসলাম অভিযোগ করেন, ‘এমপি মোবাইলে আমাকে নানাভাবে হুমকি দেন। এর কয়েক দিন পরে আমাকে রাস্তায় ধরে পেটায় তাঁর লোকজন। আমাদের ইউনিয়নের কমিটিও তাঁর হস্তক্ষেপে ভেঙে দেওয়া হয়। তিনি মোহনপুরে আওয়ামী লীগকে তাঁর পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। তাঁর ভগ্নিপতি উপজেলা চেয়ারম্যান, এক ভাই ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, আবার তিনি নিজে এমপি। ’
সুরঞ্জিত সরকার বলেন, ‘আয়েন এমপি হওয়ার পর তাঁর ক্যাডাররা আমাকে পিটিয়ে পঙ্গু বানিয়ে দিয়েছে। আমি এখনো এক পা খুঁড়িয়ে হাঁটাচলা করি। এখনো হুমকি দিচ্ছে তাঁর লোকজন। ’
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আয়েন উদ্দিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন একসময়। সেই সুবাদে ২০১৪ সালের নির্বাচনে তরুণ আয়েন উদ্দিনকে নৌকা তুলে দেয় আওয়ামী লীগ। এর পর থেকে বেপরোয়া তিনি। নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, আয়েন উদ্দিন ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের সময় হলফনামায় নিজের আয় দেখান কৃষি খাতে ৫০ হাজার, ব্যবসা থেকে দুই লাখ ২৫ হাজার, স্ত্রীর চাকরি থেকে দুই লাখ ২৮ হাজার। নিজের নগদ টাকা দুই লাখ এবং স্ত্রীর এক লাখ টাকা ছিল তখন। এ ছাড়া ব্যাংকে নিজ নামে জমা ছিল চার লাখ টাকা। নিজের পাঁচ ভরি এবং স্ত্রীর নামে ২০ ভরি স্বর্ণ দেখান। ওই সময় আয়কর নথিতে ঋণ দেখানো হয় এক্সিম ব্যাংকে ১২ লাখ ৯৭ হাজার ৭৬৬ টাকা।
২০১৮ সালে দ্বিতীয়বার এমপি হন তিনি। এই হলফনামায় আয় বেড়ে যায় কয়েক গুণ। সম্পদের বিবরণে কৃষি খাতে আয় দেখানো হয় ১১ লাখ ৭০ হাজার টাকা এবং মৎস্য খাতে ২০ লাখ টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা দেখান ৪৩ লাখ ৮২ হাজার ৯২২ টাকা। স্ত্রীর নামে দেখান চার লাখ ৭৯ হাজার ৬৯১ টাকা। সঞ্চয়পত্র আগেরবার না থাকলেও এবার দেখান ১৫ লাখ টাকার। জীবনবীমা দুই লাখ ১৯ হাজার ৩০০ টাকার। আগে কোনো যানবাহন না থাকলেও এবার যানবাহন বাবদ ৫০ লাখ ৭৫ হাজার ৮৬৫ টাকা দেখান। এ ছাড়া স্ত্রীর নামে একটি ফ্ল্যাট দেখান ৩০ লাখ টাকা মূল্যের। সেই সঙ্গে আগের ঋণও পরিশোধ হয়ে যায় তাঁর। এরপর গত চার বছরে এমপি আয়েন উদ্দিনের সম্পদ অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে।
সরেজমিনে জানা গেছে, মোহনপুরের তুলসিক্ষেত্রে শিবনদীর বাঁধসংলগ্ন বিলকুমারী বিলে শতাধিক কৃষকের জমি দখল করে তিনি গড়ে তুলেছেন ৩০০ বিঘার পুকুর ও তিনতলা বাগানবাড়ি।
মহিষকুণ্ডি গ্রামের অখিল চন্দ্র দাস বলেন, ‘আমার অনুমতি ছাড়াই ৪৮ শতক জমিতে পুকুর খনন করা হয়েছিল। পরে আমি অভিযোগ করলে আমাকে অন্য একটি জায়গায় সেই পরিমাণ দিয়েছেন এমপি। ’
অভিযোগ প্রসঙ্গে আয়েন উদ্দিন এমপি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। কাউকে নির্যাতনের প্রশ্নই আসে না। কৃষক লীগ নেত্রী হাবিবাকে সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে মামলা হয়েছিল। এখানে আমার কোনো হাত নাই। ’ জমি দখলের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার পৈতৃক সম্পত্তিই অনেক।
সংবাদ সূত্র: দৈনিক কালের কন্ঠ।