“সেই প্রজাপতিটা আর পশ্চিমপাড়ার নন্দনকাননে থাকেনা।আর আগের মত স্কুলে পড়েনা।বেশিরভাগ বন্ধুরাই এখন অতীত।মাও আগের মত নেই।বাবাময় পৃথিবীটাও যেন বাবার মত নির্বাক আর পঙ্গু হয়ে গেছে।এত বদল কীভাবে নিবে এই ছোট্ট বাচ্চাটা?”এই নিদারুন কষ্টের কথাগুলো যখন আমি পড়ছিলাম,সে সময় হৃদয়ের একপাশটা চিনচিন করছিল।নিজের অজান্তেই চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছিল।রাসেল স্যারের মৃত্যুর মাত্র পাঁচদিন আগে তাঁর সহধর্মিনী ফেরদৌস আক্তার পনি তাঁর ফেইসবুকে একটি অনুভবনীয় লেখা পোস্ট করেন।তাঁর টাইমলাইন থেকে নেয়া এই লেখাটি পড়ে নিজেকে আমি ধরে রাখতে পারিনি।কী এক বিষাদময় পৃথিবী আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।‘প্রজাপতি’ তাদের অনেক অনেক আদরের একমাত্র কণ্যা।৮ বছরের বয়সের অবুঝ প্রজাপতিকে উদ্দেশ্য করেই তাঁর এই লেখা।পূর্বের স্মৃতিচারণ করে পনি বলেন,“রাসেলের একটা স্বপ্ন ছিল,তাদের ফুটফুটে একটি মেয়ে হবে।আর তাই অনেক গবেষণা করে মেয়ের নাম রেখেছে ‘পৃথুলা প্রজাপতি’ অর্থাৎ মায়াবি প্রজাপতি।বাবার সেই স্বপ্নের মেয়েটা আজ নিজের সাথে কঠিন যুদ্ধ করছে।দিন দিনই ওর যুদ্ধটা আরো কঠিন হয়ে যাচ্ছে”।অবশেষে সেই যুদ্ধের অবসান ঘটেছে।প্রায় ৭ মাস ধরে মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে গত ৫মে মংগলবার রাসেল স্যার এই নশ্বর পৃথিবীর প্রিয় মানুষগুলোর কাছ থেকে ‘হে বন্ধু বিদায়,মোর লাগি করিয়োনা শোক’ বলে মৃত্যু নামক অমোঘ সত্যের দেশে পাড়ি জমান।রেখে যান তাঁর জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মেয়ে প্রজাপতি আর সহধর্মিনী পনিকে।
ড. মাহাবুবুর রহমান রাসেল রাবি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক।গত ২১ সেপ্টেম্বর তিনি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত রোগে আক্রান্ত হন।প্রায় ৭ মাস তিনি জীবন্মৃত অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছিলেন।এই সময়ের মধ্যে মা-মেয়ের করুণ গাথার সামান্য অংশই পনিরের ফেইসবুক ওয়ালে প্রতিফলিত হয়েছে।বদলে যাওয়া মেয়ে প্রজাপতির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন,“টয়লেটে বসেও যে বাবাকে বাচ্চার সাথে কথা বলতে হতো,প্রায় দু’ঘন্টা ডাকাডাকি-কান্নাকাটির পরও কোন সাড়া মেলেনি সেদিন ঐ বাবার অচেতন দেহ থেকে।মৃতপ্রায় বাবাকে চোখের সামনে টেনে টেনে হাসপাতালে, সেখান থেকে ঢাকায় নিয়ে গেছে এই ছোট্ট শিশুটি”।প্রাণের টুকরো এই প্রজাপতি বাবার কাছে কতটা যে প্রিয় ছিল তা আরেকটি অংশে এভাবেই বর্ণনা করেছেন,“প্রজাপতি যদি নিচে খেলতো, বাহির থেকে গলি দিয়ে ঢুকলেই জোরে একটা ডাক দিত রাসেল,আর সাথে সাথে পেট উদোম করে গায়ের টি-শার্ট উল্টিয়ে মেয়ের ঘাম মোছা শুরু করতো।সামান্য কিছু হলেই প্রজাপতি বাবার কোল ছাড়া কিছুতেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতোনা।কষ্ট হবে ভেবে অনেক সময় রাসেল অকারণেই মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে উপরে উঠতো।আমি প্রায়ই বকতাম,এত বড় মেয়েকে কোলে করে সিঁড়ি দিয়ে ওঠ কীভাবে তুমি? এই কোল যে এত অমূল্য,অপরিহার্য এই ৬ মাস আমাকে তা বুঝিয়ে দিয়েছে।কী নিষ্ঠুর নিয়তি,আমার প্রজাপতির মাত্র ৮ বছর বয়সেই তা হারিয়ে ফেললো,আর বিনিময়ে পেল জীবন্মৃত বাবাকে বহন করার ভার”। নির্মম পরিহাস! একদিন যে বাবা সামান্য কিছু হলে তাকে কোলে করে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতো,আর সেই ছোট্ট শিশুটিকে বাবার এই মর্মন্তুদ হাল দেখতে হচ্ছে!
প্রজাপতি তার মায়ের চেয়ে বাবার উপর কত বেশি নির্ভরশীল ছিল তা স্ট্যাটাসে এইভাবে তুলে ধরা হয়েছে।বাবা হাসপাতালে থাকার সময় প্রজাপতি তার মাকে একদিন দুঃখভারাক্রান্ত মনে বলছে,“মা,বাবার পরিবর্তে তুমি মরে গেলে ভাল হতো, বাবাতো আমাকে পড়ানো,খাওয়ানো,ঘুম পাড়ানো সবকিছু করে দিতো, কিন্তু তুমিতো বাবার কাজগুলো করতে পারছোনা”।এই কথা শুনে বিস্ময়ে সেদিন বোবা হয়ে গেছে মা পনি।বাবাকে হাসপাতালে কিছুতেই দেখতে যেতে চেতোনা প্রজাপতি।রাসেলের নিশ্চল, নিসাড় দেহ প্রজাপতিকে দেখে যদি একটু সচকিত হয়,সেই আশায় অনেক আদর করে,বায়না মিটিয়েও তাকে নিয়ে যাওয়া যেতোনা।পনি বলছেন,“আমি ওকে অনেকদিন ধরে একটু একটু করে বুঝিয়ে,কিছুটা ব্লাকমেইল করে একদিন হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম।দূর থেকে দেখাতে চেষ্টা করেছিলাম বাবাকে।বাবার হাড্ডিসার চেহারা দেখে সে চিৎকার করে লুকিয়ে গেছে সেদিন”।এই পর্যায়ের মানসিক অবস্থার সময় পনি লিখেছেন,“এখন প্রিয় বাবার গল্প কিছুতেই শুনতে চায়না প্রজাপতি।বাবার কথা মানেই কান্না,বাবা মানেই মন খারাপের বুলি।বাবার ছবিও এড়িয়ে যায়।বাবা-মেয়ে সংক্রান্ত কার্টুন বা নাটক দেখলে টিভি বন্ধ করে দেয়”।
প্রজাপতি বুঝতে পেরেছে,মা-ই তার এখন একমাত্র অবলম্বন।মায়ের মন খারাপের ব্যথা কিছুটা বুঝতে শিখেছে।তাই পনি স্ট্যাটাসের এক জায়গায় বলছেন,“ওর সমস্ত ক্ষমতা প্রয়োগের জায়গা এখন মা।মাকে জোর করে লিপিস্টিক দিয়ে দেয়।যে অনুষঙ্গে আমি কখনই সাজিনি,তাও পরিয়ে দিতে চায়।কবিতায় পড়া শব্দ ব্যবহার করে বলে,‘আমি তোমাকে বিবর্ণ দেখতে চাইনা’।মা আগের মত সাজলেই কী সব আগের মত হয়ে যাবে? তবু চেষ্টা করি।মাঝে মাঝে চেষ্টা ব্যর্থ হলে ওর প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হই।এলোমেলো জবাব দিলে কিংবা চুপ করে থাকলে কাঁদতে কাঁদতে বলে,‘মা,তুমি কী আস্তে আস্তে পাগল হয়ে যাচ্ছো?’ ছাত্রজীবনে ‘শ্বেতপাথরের থালা’ ছবিটা দেখে কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলাম।সেদিন কী জানতাম স্রষ্টা আমাকেই ধরিয়ে দিবে তার থেকেও দুর্বহ পাথর ”।এই কান্নার স্রোত যখন তাদের জীবনের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে,সে অবস্থাতেই পনি বলছেন,“আজ বুঝতে পারছি,কান্নার জন্যও সত্যি একটা কাঁধ লাগে।”
প্রজাপতি-পনির আঁধার জীবনের যখন এই অবস্থা,সে সময় সবকিছুর পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে তাঁদের অকূল পাথারে ভাসিয়ে গত ৫মে চলে গেলেন অজানার দেশে ছায়াদানকারি বৃক্ষটি।মা-মেয়ের কাঁধ ভেঙে গেল চিরদিনের জন্য।প্রজাপতি তার বাবার নির্মোহ আদরের সেই নিখুঁত সুরের ব্যঞ্জনার স্পর্শ আর কখনো পাবেনা।তার টি-শার্টের সেই ঘামের সুঘ্রাণ আর কখনো ভেসে আসবেনা।নিদারুণ শূন্যতা আর বিয়োগ যাতনা তাদের কুরে কুরে খাবে।কষ্টের প্রহরগুলো প্রতিনিয়ত মা-মেয়েকে আচ্ছন্ন রাখবে।জমাট কান্নার ঢেউ বার বার উথলে উঠবে।হারিয়ে যাওয়া মানুষটির অস্তিত্ব প্রতিনিয়ত তাদের তাড়া করে ফিরবে।প্রজাপতি-পনিরের এই তিমির ঘন অন্ধকারের করুণ আর্তনাদ কোনদিনও পৌঁছাবেনা তাদের প্রিয় মানুষটির কাছে।জানি, কোনো শান্ত্বনার বাণীই তাদেরকে শান্ত করতে পারবে না।‘তবুও যেতে দিতে হয়,তবুও চলে যায়’।এভাবেই চলছে এই জগৎ।শত শোকের মাঝেও পথ চলতে হয়।স্বপ্ন ভেঙে যায়,কিন্তু জীবন থেমে থাকেনা।কালের পরিক্রমায় জীবনধারাটা হয়তো বদলে যাবে।বেঁচে থাকাটা হয়তো আগের মত আলোকিত হবেনা।তারপরেও জীবনকে চালিয়ে নিতে হয়, চলতে দিতে হয়।বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তাইতো বলেছেন,“একদিন এই দেখা হয়ে যাবে শেষ/পড়িবে নয়ন ‘পরে অন্তিম নিমেষ/পরদিন এইমতো পোহাইবে রাত/জাগ্রত জগত ‘পরে জাগিবে প্রভাত/কলরবে চলিবেক সংসারের খেলা/সুখে-দুখে ঘরে ঘরে বহি যাবে বেলা”।
লেখক : উপ-রেজিষ্ট্রার,রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
(বয়সের অনেক ফারাক থাকলেও মাহাবুবুর রহমান রাসেলের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মত।সদা হাস্যোজ্জ্বল,খোলামনের এই মানুষটি আমার খুব প্রিয় ছিল।কখনো লেখক হিসেবে,কখনো ছাত্র-শিক্ষক,কখনো অফিসিয়াল কাজ-কর্মের মধ্য দিয়ে মিলেমিশে আমাদের সম্পর্কটা ছিল খুবই মধুর।তাঁর অসুস্থতার ধরণ এবং চলে যাওয়াটা আমার জন্য অনেক কষ্টের।আজো তাঁর স্মৃতি আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।আল্লাহ যেন ম্যাডাম এবং প্রজাপতিকে শোক সইবার শক্তি দেন)।