স্টাফ রিপোর্টার: গাজীপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পিকনিকের বাসে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে রাজশাহীর জুবায়ের আলম সাবিকসহ মোট তিন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় কমপক্ষে ১০ জন আহত হয়েছে।
শনিবার (২৩ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ৮টায় শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের উদয়খালী গ্রামের স্থানীয় চায়না কারখানার সামনে এ ঘটনা ঘটে।
নিহত তিনজন হলেন, মীর মোজাম্মেল নাঈম (২৩), জোবায়ের আলম সাকিব (২২) ও মুবতাছিন রহমান মাহিন (২২)। তারা সবাই ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি) বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। জুবায়ের আলম সাবিক রাজশাহীর পবা উপজেলার মুরারীপুর এলাকার বাসিন্দা। তারা সবাই মেকানিক্যাল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।
স্থানীয় বাসিন্দা আফসার উদ্দিন (৭০) জানান, গাজীপুরের বোর্ড বাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি) বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের সাড়ে ৪৬০ জন শিক্ষার্থী ওই এলাকার ‘মাটির মায়া’ রিসোর্টে ছয়টি বিআরটিসি দোতলা বাস এবং তিনটি মাইক্রোবাস নিয়ে পিকনিকে আসেন। তেলিহাটি ইউনিয়নের উদয়খালী গ্রামে পৌঁছানোমাত্র সড়কের পাশ দিয়ে যাওয়া ১১ হাজার ভেল্টেজের লাইনে একটি বাস (নং ঢাকা মেট্রো ব-১৫৭০৩৮) বিদ্যুতায়িত হয়। এ সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলে দুই ছাত্রের মৃত্যু হয়। আহতদের শরীরের বিভিন্ন অংশ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে কারও হাত, কারও পা, কারও মুখ ঝলসে যায়।অপর প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পাঁচটি বাস রিসোর্টে চলে যায়। সব শেষের বাসটি সড়কের পাশের ১১ হাজার ভেল্টেজের লাইনে বিদ্যুতায়িত হয়। এ সময় বাস থেকে দোঁয়া বের হতে থাকলে ছাত্ররা চিৎকার শুরু করেন। আমরা তাদের চিৎকার শুনে বাসের কাছে যাই। এ সময় তিন জন ছাত্র বাস থেকে নেমে বের হওয়ার চেষ্টা করলে তাদের একজনের মৃত্যু হয়। অপর দুই জনকে শুকনো বাঁশ দিয়ে উদ্ধারের চেষ্টা করি। পরে বিদ্যুৎ অফিসে ফোন দিয়ে বিদ্যুৎ লাইনের সংযোগ বন্ধ করতে বললে তারা বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয়।
ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) খন্দকার মাহমুদুল হাসান জানান, ওই লাইনটি ১১ হাজার ভেল্টেজের ছিল। সড়কের ওপর দিয়ে বিদ্যুতের লাইন ক্রস করা অবস্থায় রয়েছে। একটি বাসকে সাইড দিতে গিয়ে দোতলা বাসটি একটু হেলে পড়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে। শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জয়নাল আবেদীন ম-ল জানান, পিকনিক বাস বিদ্যুতায়িত হয়ে তিন ছাত্রের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হয়েছি।
এদিকে, মৃতদের একজন জোবায়ের আলম সাকিব। সে রাজশাহী পবা উপজেলার মুরারীপুর এলাকার জাহাঙ্গীর আলমের ছেলে।বাসটিতে থাকা প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীদের বরাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রভাষক মো. মুহতাশিম মাশফি বলেন, আমরা পিকনিক স্পটে পৌঁছে যাওয়ার ৩০ মিনিট পর দুর্ঘটনার খবর পাই। শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে পেরেছি, বাসটি হেলে যাচ্ছিল। ওই সময় পাশের বৈদ্যুতিক তারের সংস্পর্শে চলে আসে বাসটি। ওই সময় মুবতাছিন রহমান মাহিন দোতলায় তার বন্ধুর ব্যাগ আনতে যাচ্ছিল। এ সময় গেটের হাতলের কাছে যেতেই প্রথম বিদ্যুতায়িত হয় সে। বন্ধু ছটফট করছে দেখে নিজের সিট থেকে দৌঁড়ে যায় জোবায়ের আলম সাকিব। সে বন্ধুকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। এসময় জোবায়ের আলম সাকিবও বিদ্যুতায়িত হয়ে গুরুতর আহত হয়। পরে দুজনেই মারা যায়।
তাদের দু’জনের সহপাঠীরা জানান, তারা একই বাসে ছিলেন। চোখের পলকে দুর্ঘটনাটি ঘটে গেল। এই বন্ধুদের সঙ্গে গতকাল রাত দুইটা পর্যন্ত একসঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন তারা। বাসে নাচানাচি করে পিকনিকে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এ ঘটনায় সব আনন্দ শেষ হয়ে গেলো। সেই মুহূর্ত বর্ণনা করার মতো নয়। তিন বন্ধুর শরীর পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে।এদিকে, মৃত্যুর খবরে জোবায়ের আলম সাকিবের বাড়িতে কান্না ও আহাজারির রোল পড়েছে। ব্যাংকার বাবা জাহাঙ্গীর আলম ও মুরারীপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সেফালি বেগমের একমাত্র ছেলে সন্তান সাকিব।সকালে মৃত্যুর খবর শোনার পরপরই তার বাবা-মা ও নিকট আত্মীয়রা ময়মনসিংহ হাসপাতালের উদ্দেশ্য রওনা দেন। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা বাবা-মা।শনিবার সন্ধ্যায় সাবিকের বাড়িতে দেখা যায়, তাদের বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনরাও ভিড় করেছেন। কান্না ও আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে আকাশ-বাতাস। লাশের অপেক্ষার প্রহর গুণছেন স্বজনরা।সাকিবের স্বজনরা জানান, সাকিব খুবই ন¤্র ও ভদ্র স্বভাবের মেধাবী ছাত্র ছিলো। বাবা-মায়ের একমাত্র আদরের সন্তান সাবিক। বাবা-মা সাধারণত তাকে একা কখনোই ছাড়তো না। শিক্ষকদের সঙ্গে পিকনিকে যাবে একারণেই পরিবার থেকে অনুমতি দিয়েছিলো। রাতেও ফোনে সাবিকের সঙ্গে তার মা কথা বলেছে। সে সময়েও হাসিমুখে কথা বলেছে সাকিব। কিন্তু কে জানতো সকালে মৃত্যুর খবর আসবে। তার মৃত্যুতে পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
অপরদিকে, মৃত মুবতাছিন রহমান মাহিনের বাড়ি রংপুর নগরীর জুম্মাপাড়ায়। মাহিনের বাবা ইমতিয়াজুর রহমান এবি ব্যাংকের সৈয়দপুর শাখার ব্যবস্থাপক। ছেলের মৃত্যুর খবর স্ত্রীকে শোনান নি। তিনি মাহিনের মরদেহ আনতে সৈয়দপুর থেকে ঢাকার পথে রওনা হয়েছেন।
মাহিনের চাচা হাসান রহমান জানান, আইইউটি ইউনিভার্সিটিতে ক্যারিয়ার অ্যান্ড বিজনেস সোসাইটিতে শেষ বর্ষে পড়ছিল মাহিন। সকালে সে বাসে বিদ্যুতায়িত হয়ে পুড়ে মারা গেছে। মাহিনের বাবা ঢাকার পথে রওনা দিয়েছে। বিষয়টি এখনও তার মাকে জানানো হয়নি। ছেলের মৃত্যুর খবর তার মা সহ্য করতে পারবে না। এ জন্য বাড়ির আশেপাশে কাউকে আসতে দেওয়া হচ্ছে না।এদিকে, পিকনিক বাস বিদ্যুতায়িত হয়ে তিন ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনায় গাজীপুর জেলা প্রশাসক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) নাফিসা আরেফিন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি রাকিবুল ইসলাম তদন্ত কমিটি গঠনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। জেলা প্রশাসকের তদন্ত কমিটিতে গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সালমা আক্তারকে প্রধান করে চার সদস্যর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সজীব আহমেদ, ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) খন্দকার মাহমুদুল হাসান ও আরেকজনের নাম জানা যায়নি।
অপরদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি ও ইলেক্ট্রিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান রাকিবুল ইসলামকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। চার জনের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন, রেজিস্ট্রারসহ আরও দুই জন রয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি রাকিবুল ইসলাম বলেন, আমরা বছরের পর বছর দ্বিতল বাসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পিকনিক করে থাকি। দুর্ঘটনা এলে বলে কয়ে আসে না। দুর্ভ্যাগ্যবশত একটা ঘটনা ঘটে গেছে। এটা কাউকে দোষ দেওয়ার চেয়ে কীভাবে উত্তরণ করা যায়, কীভাবে আহতদেরকে চিকিৎসা করানো যায়, যেসব শিক্ষার্থী সেভ আছে তাদেরকে কীভাবে নিরাপদে পৌঁছানো যায়- সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তদন্ত করার পর বলা যাবে এটি দুর্ঘটনা কি না।গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সালমা আক্তার, শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ব্যারিস্টার সজীব আহমেদসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।